বাংলাদেশের বিশিষ্ট অভিনেত্রী, আবৃত্তিশিল্পী এবং নাট্যশিল্পী শিরিন বকুল। বর্তমানে তিনি বসবাস করছেন নিউইয়র্কে। মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে এফএম-৭৮৬’র বিশেষ আয়োজন "বিজয়ের গল্প" তে অতিথি হিসেবে এসেছিলেন তিনি। কথা বলেছেন মুক্তিযুদ্ধকালীন নানা স্মৃতি, ব্যক্তিগত জীবন এবং সংস্কৃতি অঙ্গণ নিয়ে। সঙ্গে ছিলেন আরজে মোহনা।
আরজে মোহনা: শুরুতেই প্রবাসে বিজয় দিবস উদযাপনের অনুভূতি জানতে চাই?
শিরীন বকুল: সাড়ে ৩ বছরের প্রবাস জীবন আমার। উত্তর আমেরিকায় এতো এতো বাঙালি আছে যে মনেই হয় না বাংলাদেশে নেই। এখানেই এক টুকরো বাংলাদেশ আছে। প্রতিটি বাংলা উৎসব, পালা-পার্বন এখানে উদযাপিত হচ্ছে। আর বিজয়ের উৎসব তো সব আনন্দকেই ছাপিয়ে যায়। তবে একটা বিষয় কি, দেশে থাকতে তো প্রতিটি দিনই সকাল ৯টা থেকে শুরু করে রাত ১২/১টা পর্যন্ত শুটিং এ ব্যস্ত থাকতে হতো। তাই বিশেষভাবে কোনো দিবস, উৎসব উদযাপন করার সুযোগ ছিলো না। এখন সেই সুযোগ টা আছে। তবে আমি এখানে এসেও ব্যস্ত হয়ে পরেছি। একটা স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেছি। আসার পরপরই যুক্ত হয়েছি " ঢাকা ড্রামা" থিয়েটারের সাথে। তবে করোনা আমাদের সকলের জীবনকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে।
আপনার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা কোথায়?
দাদা বাড়ি মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুরে। আট ভাইবোনের মধ্যে আমি ষষ্ঠ। আব্বা সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। চাকরির সুবাদে নানা জায়গায় থাকা হয়েছে। আমার জন্ম ঢাকাতে। ধানমন্ডি গার্লস স্কুল, ইডেন কলেজ পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই ছিলো শিক্ষাজীবন। পড়ালেখা, নাচ, গান, আবৃত্তি, অভিনয়, লেখালেখি সব মিলিয়ে বর্ণাঢ্য জীবন ছিলো আমার।
ছোটবেলার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিশেষ কোনো স্মৃতি জানাবেন?
মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা ছিলাম ময়মনসিংহ শহরে। আব্বা আর মেঝ ভাই গিয়েছিলেন সিলেটে। তখন সারা দেশজুড়ে ভয়াবহ অবস্থা। আমরা ময়মনসিংহ শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গিয়েছিলাম। আম্মা আমাদের একেকজন কে একেক জায়গায় রেখেছিলেন যেন মরলেও সবাই একসাথে না মরি। অনেকটা নাটকীয়ভাবে দশ দিন দশ রাত আব্বা আর মেঝ ভাই পায়ে হেঁটে সিলেট থেকে ময়মনসিংহ এসেছিলেন। অনেক কষ্টে আমাদেরকে খুঁজে বের করে ট্রেনে করে ঢাকায় এসেছিলাম। এই ট্রেন যাত্রায় মা আমাদের ছোট সব ভাইবোনগুলোকে পুরো রাস্তাজুড়ে চকলেট-টফি কিছু না কিছু মুখে গুঁজে রেখেছিলেন যেন ট্রেনের কামড়ায় থাকা অন্য দুটি বিহারি পরিবার বুঝতে না পারে যে আমরা বাঙালি। কমলাপুর রেলস্টেশনে আব্বাকে পাকিস্তানি গোয়েন্দারা আটকে অনেকক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলো। চাকরি করার অভিজ্ঞতায় বাবা খুব ভালো উর্দু বলতে পারতেন। তাও তারা ছাড়ছিলো না। শেষমেশ ক্ষুধায় যখন আমরা ছোট সব ভাইবোনগুলো কান্না করছিলাম তখন আব্বাকে ছেড়ে দেয়া হলো। তারপর আমাদের ধানমন্ডি ১৯ এর বাড়িতে গিয়ে উঠলাম এবং পরবর্তীতে সেখানেই ছিলাম।
সাংস্কৃতিক অঙ্গণে আপনার পথচলা শুরু কিভাবে?
আমার প্রথম ভালোবাসা আবৃত্তি। কলেজ পাশের পরে আবৃত্তি শিখতাম, করতাম। তারপর থিয়েটারে ঢুকলাম, তারপর তো নাটকেই পুরো সময় ব্যয় করলাম। পরে অবশ্য নাটকের ব্যস্ততার জন্য আবৃত্তি ছেড়ে দিতে হয়েছিলো। রেডিওর নাটক আমাকে খুব টানতো।
আপনার অভিনীত সেরা নাটক বা বিশেষ কোন চরিত্রের কথা জানাবেন?
ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর যখন থিয়েটার শুরু করলাম, সেখানে আমার প্রথম মঞ্চ নাটক ছিলো সৈয়দ শামসুল হকের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক নাটক ‘যুদ্ধ এবং যুদ্ধ’। সেখানে আমার চরিত্র ছিলো একজন বুদ্ধিজীবীর স্ত্রী। নাটকের শেষের দিকে গিয়ে সকল শিল্পী, কলাকুশলী এবং সকল দর্শকদের চোখেই জল ছিলো।
আপনার কাজের অনুপ্রেরণা কে? পরিবারের কেউ কি সাংস্কৃতিক অঙ্গণে সাথে জড়িত?
আব্বা খুব গান ভালোবাসতেন। আমি যখন থিয়েটার করতাম তিনি আমাকে আনতে যেয়ে বলতেন এসব করে কি হবে, তুই মন দিয়ে গানটা কর। তিনি খুব শিল্পমনা মানুষ ছিলেন। প্রকৃতি এবং মানুষের প্রতিটি পরতে পরতে তিনি সৌন্দর্য তো খুঁজতেন। একই সাথে ভীষণ মানবিক ছিলেন। এক কথায় সাধারণের আবরণে ঢাকা এক অসাধারণ মানুষ ছিলেন তিনি। অন্যদিকে মা ছিলেন আপাদমস্তক সংসারী। সব মিলিয়েই আমি আজকের শিরীন বকুল।
বর্তমানের নাট্যকর্মীদের উদ্দেশ্যে আপনার পরামর্শ কি?
কাজের প্রতি আন্তরিকতা বাড়াতে হবে, যত্নশীল হতে হবে। অভিনয়টা শিল্প। আমাদের সময় পারিশ্রমিক অল্প হলেও ভালো কাজ হতো। কিন্তু একটা সময় মানুষ শিল্পীর মানদণ্ড হিসেব করতে শুরু করলো পারিশ্রমিক দিয়ে। শিল্প যখন থেকে পণ্য হলো তখন থেকেই কাজের পরিসর ছোট হতে শুরু করলো। তবুও বেশ কিছু ভালো কাজ হচ্ছে।
প্রবাসী বাঙালিদের সাথে কাজ করার ইচ্ছা কি আছে?
অবশ্যই, আমি নাটক, আবৃত্তি, সঞ্চালনা ভালোবাসি। সুযোগ পেলে অবশ্যই করবো। কিন্তু এখানে এসে আমি একটা বিষয়ে হতাশ। এতো বাঙালি শিল্পী থাকা সত্ত্বেও এখানকার মানুষের আগ্রহ খুবই কম। আগে যখন আমরা মঞ্চ নাটক করতাম তখন একেকটা নাটক ১০০/১৫০ টা করে শো হতো। কিন্তু এখানে দেখা যায় ৪/৫ টা শো। এরপর আর কোনো দর্শক থাকে না। তাছাড়াও বড় কোনো অডিটোরিয়াম ভাড়া করেও কাজ হয়না।
বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার প্ল্যান আছে কি?
এসেছিলাম ৩মাসের জন্য। ছেলেকে ভর্তি করিয়ে সেটেল করে দিয়ে চলে যাওয়ার প্ল্যান ছিলো। নানা কারণে আটকা পরেছিলাম। এক বছরের মাথায় মা মারা গেলেন তখন আর দেশে ফিরতে ইচ্ছে হলো না। মনে হতো দেশে গেলেই তো মায়ের না থাকার শূন্যতা, এটা আমি কোনো ভাবেই মানতে পারছিলাম না। তবে এবার পরিস্থিতি ঠিক হলেই দেশে ফিরে যাবো। যেয়ে আবার কাজে ফিরবো। প্যাকেজ নাটক,রেডিওতে নাটক এসব খুব মিস করি।
বাংলাদেশের মানুষের উদ্দেশ্যে কি বলবেন?
সবাইকে বলতে চাই মানবিক হোন,শিল্পকে ভালোবাসুন। বাংলাদেশের বুকে যেন একজন মুক্তিযোদ্ধা বা তাদের পরিবার অভাবে না থাকেন, অসম্মানিত না হন কারণ তাদের জন্যই আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন ভূখণ্ড,একটি পতাকা, একটি দেশ।
করোনা নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?
শুধু এই নিউইয়র্কেই করোনায় মৃত্যু হয়েছে ৩লাখ মানুষের। এটা নিশ্চয়ই অপূরণীয় ক্ষতি। তবে ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়ে গিয়েছে, নিউইয়র্কে দেয়া শুরু হয়েছে। বাংলাদেশে কবে ভ্যাকসিন যাবে সেটাই ভাবার বিষয়। তবে বাঙালি বীরের জাতি। তারা নানা দুঃখে-কষ্টে- রোদ-বৃষ্টিতে পুড়ে সোনা হয়ে গিয়েছে।